ক্লিনিক ডাক্তার
মোঃ মিলন হক। কথাসাহিত্যিক
এই ক্লিনিকটি অবস্থিত উদয়পুর গ্রামে। ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়।গ্রামের দরিদ্র , অসহায় এবং সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের। বিশেষ করে ক্লিনিক হতে জ্বর সর্দির জন্য নাপা, পেরাসিটাম, হিস্টাসিন ক্যালসিয়াম ও আয়রন জাতীয় টেবলেট প্রদান করা হয়। ছোট ছোট শিশুদের বিনামূল্যে বিভিন্ন টিকা দেওয়া হয়। এছাড়াও স্বাস্থ্য সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতন করা হয়। ক্লিনিকে প্রতিমাসে ওষুধ আসে উপজেলার সরকারি হাসপাতাল থেকে।
ক্লিনিক ডাক্তার একজন মহিলা।তার নাম মোছাঃ রুবি বেগম। তার কর্মস্থল শহর থেকে মাঘ মাসের শেষের বদলি করে,গ্রামে পাঠানো হয়েছে ।
নিতান্ত এক গ্রাম। গ্রামের মানুষ সুবিধা বঞ্চিত এবং যাতায়াত ব্যবস্থা নিম্নমানের।
রুবি গ্রামের পরিবেশে অভ্যস্ত না। তার জন্ম শহরে, বিয়ে হয়েছে শহরে।তার স্বামী আব্দুর রফিক একজন ব্যাংকার।রুবির একটি চার বছরের ছেলে আছে। ছেলের নাম হাসান ।
চাকরি সূত্রে এই প্রথম রুবির গ্রামে আসা।যে দিন গ্রামে এসেছিল, তার আগে তার স্বামী এসে রুবির জন্য বাসা ভাড়াও বাসার সব বন্দোবস্ত করে গেছে। রুবি গ্রামে আসে শুক্রবার বিকেলে। গ্রামের আসার দিন তার সঙ্গে তার স্বামী ও ছোট ননদ আসে।শুক্রবার, শনিবার ক্লিনিক বন্ধ থাকে। শনিবার বিকেলে তার স্বামী চলে যায় অফিসে। তার সঙ্গে থাকে তার ননদ ও ছেলে।
পরেরদিন দিন অর্থাৎ রবিবার সকালে রুবি তার ননদ কে সঙ্গে নিয়ে ক্লিনিকে যায়। সাড়ে নয়টায়।বাসা থেকে ক্লিনিকের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। দশটায় বিভিন্ন বয়সের মহিলারা আসে তাদের সমস্যা ও ছোট ছেলে মেয়েদের সমস্যা নিয়ে। সবাই নতুন ডাক্তার পেয়ে বেশ উৎচ্ছাশ্বিত। মহিলারা জিজ্ঞাসা করে,আপনার নাম কি? বাড়ি কোথায়? স্বামী কি করে?
ইত্যাদি।রুবি বলে,তার নাম রুবি।
বাড়ি মঙ্গলপুর। স্বামী একজন ব্যাংকার। বাড়িতে শ্বশুর,শাশুড়ি আছে।ননদ ছোট তাই তার সঙ্গে এসেছে।
নতুন ডাক্টার আসার খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখার জন্য, বিভিন্ন মহিলারা আসে দলে দলে। মহিলাদের সঙ্গে আসে মা মরা মেয়ে মাফিয়া।
মাফিয়ার বয়স তের বছর। তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সৎমায়ের ঘরে এক ছেলে ও মেয়ে আছে।সৎ মা মাফিয়াকে তীব্র প্রহার ও নির্যাতন করে। মাফিয়া তার দাদির কাছে থাকে। ডাক্টারকে মাফিয়ার তার মায়ের মতো মনে হয়।
গ্রামের যুবক বৃদ্ধ সবাই আসে ক্লিনিকে, রুবির কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। রুবি বৃদ্ধদের বেশ সম্মানের সহিত চিকিৎসা দেয়। ছোট ছোট বাচ্চারা চিকিৎসার জন্য এলে, তাদের পরম আদর স্নেহ করে। রুবির প্রথম দিকে মন খারাপ
থাকলেও,নিজেকে মানিয়ে নেয় কয়েক দিনের মধ্যেই।বেশ আনন্দে ও প্রশান্তিতে গ্রামে ও ক্লিনিকে সময় অতিবাহিত হচ্ছে।গ্রামের কাছেই ক্লিনিক হওয়াতে,মহিলারা আসে অবসর সময়ে গল্প করতে। রুবি তার ননদ কে কিছু দিন পর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কারণ তার ননদ দশম শ্রেণীতে পড়ে, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা।দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল।
মাফিয়া প্রতিদিন সকালে আসে রুবিকে দেখতে ।
–মাতৃহীনার অন্তরে মাতৃত্রীত্বের স্নেহের লোভে।
রুবি একদিন জিজ্ঞেস করে,কী নাম তোমার?
মাফিয়া কান্নাভেজা স্বরে বলে,মাফিয়া
। রুবি বলে, কান্না করে কেন?
মাফিয়া বলে,আপা, এমনিতেই কান্না পাইলো।
বেশকিছু দিন থেকে রহিমা বেগম অসুস্থ। ক্লিনিক ঝাড়ু দিতে পারছে না।রুবি মাফিয়াকে বলে, তুমি আজ থেকে ক্লিনিক ঝাড়ু দাও। বাবুর সাথে খেলবে। মাসের শেষে টাকা দিব।
তোমার মাইনে পনেরো`শো টাকা। মাফিয়া রাজি হয়ে যায়।রুবি পরে দিন থেকে কাজ শুরু করতে বলে মাফিয়াকে।
মাফিয়া পরের দিন সকাল নয়টায় আসে, ক্লিনিক ঝাড়ু দেয়।ঝাড়ু দেওয়া শেষে ক্লিনিকের সামনের বটগাছের নিচে বসে মাটি কেটে , ঘর বানানোর ছবি আঁকে। দশটায় রুবি আসে দেখে, মাফিয়া ঝাড়ু দিয়ে সব পরিষ্কার করে গাছের নিচে খেলতেছে। এরপর লোক জন আসে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। মাফিয়া হাসানকে নিয়ে মাটিতে খেলে। খেলা শেষ হলে তারা হাত মুখ ধুয়ে আসলে, রুবি দু’জনকে দুইটা পাউরুটি খেতে দেয়।
বারোটায় রুবির কাছে বৃদ্ধ ফজলুল হক আসে বলে, মা,তোর চাচীরে বাঁচা রে- মা।তোর চাচী দুই দিন থেকে বিছানা থেকে, উঠতে পারে না রে মা।
আমি গরীব তোর চাচীর চিকিৎসার জন্য টাকা নেই ! তাই আজ দুই দিন থেকে কোন ওষুধ কিনে দিতে পারি নি মা! তাই তোর কাছে ছুটে এলাম।
রুবি কিছু ওষুধ পত্র দেয় এবং বলে দুপুরে গিয়ে দেখে আসবো। ওষুধ নিয়ে ফজলুল চলে যায়।
জোহরা আসে তার থেকে নিয়ে,জোহরার ছেলের সর্দি কাশি লেগে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। দুপুরে ক্লিনিক বন্ধ করে মাফিয়ার সঙ্গে রুবি ফজলুলের বাড়ি যায়।দেখে ফজলুলের স্ত্রী আমেনার অবস্থা অশোচনীয়। আমেনাকে দেখার পর যায় ঝাড়ুদার রহিমার বাড়ি। রহিমার অবস্থা ভালো নেই।শুয়ে আছে খাটের মাচার ওপর।
আসার সময় রুবি ফল ও ভালো কিছু খাওয়ার জন্য,দুই হাজার টাকা দিয়ে আসে।
এরপর রুবি প্রায় দুপুরের পর ক্লিনিক বন্ধ করে, মাফিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফজলুল হকের স্ত্রীকে দেখতে যায়। রুবির তত্ত্বাবধানে আমেনা সুস্থ হয়ে ওঠে। মফিজের কোমর ব্যথার ওষুধ দেয়।শানুর চোখের পানি পড়া বন্ধ ও বড় ডাক্তার দেখানোর জন্য পরামর্শ দেয় তার বাড়িতে।রুবি গ্রামের মানুষদের সবার বাড়িতেই ঘুরতে যায়। সবার ভালো-মন্দ খোঁজ খবর নেই। সবাইকে পরিবার পরিকল্পনা ও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেয়। রুবিকে গ্রামের যুকব যুবতীরা দিদি মণি
বলে সম্বোধন করে।
একদিন বৈশাখ মাসের শুক্রবার সন্ধ্যায় দুলুমিয়ার স্ত্রী মর্জিনা বেগম বাচ্চা প্রসবের বেদনায় খুব অস্থির হয়ে পড়ে।হাসপাতালে যাওয়ার মতো টাকা নেই। নাজেরা বেগমের বাড়ী ক্লিনিকের পার্শ্বে। নাজেরার কাছে রুবির নাম্বার ছিল।যেন যে কেউ জরুরী অবস্থায় কল দিতে পারে।দুলুমিয়া নাজেরার কাছ থেকে,রুবির নাম্বারের ব্যবস্থা করে কল দিয়ে বলে, দিদি আমি তোমার দুলু ভাই। দিদি আমার বউয়ের বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা । আমি কি করব বুঝতেছিনা!
যদি আপনি আসেন, তাহলে কোন একটা ব্যবস্থা হবে আমার বউয়ের।
রুবি বলে,আমার স্বামীকে নিয়ে আমি যাচ্ছি একটু পরেই।
শুক্রবার , শনিবার ব্যাংক বন্ধ থাকে।
রফিক প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে রুবির কাছে আসে, এবং শনিবার বিকেলে ব্যাংকে চলে যায় । এরপর খবর পেয়ে, দুজনে দুলুর বাড়িতে যায়। গিয়ে দেখে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার বেশি ক্ষণ নেই ।রুবির প্রচেষ্ঠায় দুলুর স্ত্রী মর্জিনার পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ করে। দুলু তার বাড়িতে রাতে খাবারের জন্য অনেক অনুনয় করে ,রুবি ও রফিকের কাছে। তারা রাতের খাবার দুলুর বাড়িতে খেয়ে, নিজেদের বাসায় চলে যায়।
শনিবার বিকেলে রফিক ব্যাংকে না গিয়ে থেকে যায় রুবির কাছে। রবিবার সকালে সে ব্যাংকে চলে যায়। এরপর রুবি ক্লিনিকে আসে হাসানকে নিয়ে। হাসান মাফিয়ার সাথে খেলে । মাফিয়াকে ডাকে আপু বলে ।রুবি তাদের খেলার জন্য অনেক আসবাবপত্র কিনে দিয়েছে। খেলার জন্য ছোট, ছোট ছেলে -মেয়েরাও আসে। ছেলে -মেয়েরা খেলার জন্য ভাট পদ্ম , জবা , কেয়া ফুল ও সাথে নিজে আসে । এবং তাদের বিভিন্ন আসবাবপত্র নিয়ে আসে।
রুবি সকালে ক্লিনিকে রোগী দেখে । দুপুরে গিয়ে খাওয়া করে ঘুমায় । বিকালে বাসার কাছে খোলা জায়গায় গাছের বাগান করেছে সেটার পরিচর্যা করে। বাগানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ বেশি। সন্ধ্যায় হাসানকে পড়তে বসায়।রাতে খাওয়া দাওয়া করে, টিভি দেখে পত্রিকা পড়ে এবং ঘুমায়। এভাবেই গ্রামে তার দিবস অতিবাহিত হয়।
রুবি ক্লিনিকে আসার অনেক আগে থেকেই ক্লিনিকের বটগাছের তলায় একটা কুকুর ছিল।কুকুরটা সারাদিন বটগাছের তলায় শুয়ে থাকতো।খুদা পেলে এদিকে সেদিক থেকে কিছু খেয়ে আবার এসে শুয়ে থাকতো।
রুবির কুকুরটা স্নেহ করতো এবং প্রতিদিন বিস্কুট খেতে দিত। কুকুরটা প্রায় রুবির আসার জন্য শুয়ে অপেক্ষা করতো।দুই-তিন বার রুবির সাথে তার বাসা পর্যন্ত এসেছে। বাসায় এলে, রুবি মাছ – মাংস খেতে দিত। মাফিয়ার ও কুকুরটার সাথে ভালো সম্পর্ক হয়।
জৈষ্ঠ্যের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রফিক আসে, এবং রাতে রুবি খবর পায়। তার বদলি হয়েছে উজুমুনি গ্রামে। উজুমুনি গ্রামে রবিবার থেকে রোগী দেখতে হবে।রফিক আবার আগের মতোই শুক্রবার সকালে উজুমুনি গ্রামে বাসার বন্দোবস্ত করার জন্য যায়। রুবির সারাদিন ভীষণ মন খারাপ গ্রামের সবার সাথে কাটানো স্মৃতি মনে পড়ে।আর কারও সাথে দেখা হবে না, কথা হবে না। এর জন্য বাসায় কান্না করে। সন্ধ্যায় রফিক ফিরে আসে বাসার বন্দোবস্ত করে। সকালে বাসা পরিবর্তন করে চলে যায় উজুমুনি গ্রামে। যাওয়ার আগে নাজেরাকে জানিয়ে যায় তার বদলির কথা।
কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে বলতে যে,উজুমুনি গ্রামে গেছে তাদের দিদিমণি।
মাফিয়া প্রত্যহ সকালেই এসে,ক্লিনিক ঝাড়ু দিয়ে যেমন রুবির স্নেহের অপেক্ষায় থাকে তেমনি রবিবার সকালে বটগাছটার তলে বসে রয়েছে। পাশেই কুকুরটি ঘুমাচ্ছে। রুবি আসে না।পরে এগারোটায় নাজেরা সবাইকে বলে, আজ ক্লিনিক বন্ধ থাকবে।দিদিমণির বদলি হয়েছে।উনি উজুমুনি গ্রামে চলে গেছে। আমাদের সাথে দেখা করতে আসার সময় পাই নি। মাফিয়া একথা শুনে কান্না করতে শুরু করে।
মাফিয়ার কান্না দেখে কুকুরটি ও কান্না করতে শুরু। গ্রামবাসীরা ও অনেকেই কান্না করে রুবির বদলি হওয়ার কথা শুনে।