ইমরান বিন সুলতান
নভেম্বরের এক শীতল রাত। চারপাশে ঘন কুয়াশায় সব কিছু ঢেকে গেছে। রাস্তা ফাঁকা, বাতাস ভারি। কুয়াশার পরতে ঢাকা বনের মাঝ দিয়ে সাপের মতো পেঁচানো পথটি চলে গেছে দূরে কোথাও। সে রাতে, এক একাকী পথিক সেই পথ ধরে হাঁটছিল। তার গায়ে মোটা চাদর জড়ানো, আর হাতে একটি লণ্ঠন, যার ক্ষীণ আলো কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে।
পথিক আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল, হঠাৎ তার কানে এল দূর থেকে ভেসে আসা এক সুরেলা বাঁশির আওয়াজ। আশ্চর্য! এমন গভীর রাতে, এমন জনহীন জায়গায় কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে? সে থেমে গেল, কিছুটা বিস্মিত আর কৌতূহলী হয়ে।
বাঁশির সুর তাকে মুগ্ধ করল। সে শব্দের উৎস খুঁজতে চলল। হাঁটতে হাঁটতে সে একটি ছোট্ট নির্জন হ্রদের পাড়ে পৌঁছল। কুয়াশায় ঢেকে থাকা হ্রদটির পানিতে চাঁদের আলোর প্রতিফলন ঝলমল করছিল, আর হ্রদের ধারে বসে ছিল এক সাদা পোশাক পরা অবয়ব। সেই অবয়বই বাঁশি বাজাচ্ছিল।
পথিক সাহস করে এগিয়ে গেল। সে দেখতে পেল, অবয়বটি এক যুবতীর, যার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, কুয়াশায় তার মুখ ঢাকা।
পথিক ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল, “এত রাতে তুমি এখানে একা বসে আছ কেন?”
যুবতী কিছু বলল না, বাঁশি বাজানো থামিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাল। এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি পথিকের শরীরে বয়ে গেল। সেই চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত দুঃখ আর এক গভীর রহস্য লুকিয়ে ছিল।
যুবতী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি এখানে অপেক্ষা করছি, এক প্রতীক্ষা যা শেষ হবে না।”
পথিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিসের অপেক্ষা? তুমি কাকে খুঁজছ?”
যুবতী ধীরে ধীরে বলল, “যে কথা দিয়েছিল ফিরে আসবে, সে কখনো আসেনি। তাই আজও এই কুয়াশা ভেজা রাতে আমি তার অপেক্ষায় থাকি।”
পথিক আর কিছু বলতে পারল না। সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এই যুবতী মানুষ নয়, সে যেন এক অতৃপ্ত আত্মা, যাকে এক অসম্পূর্ণ প্রতিজ্ঞা বেঁধে রেখেছে। সে যুবতীর দিকে তাকিয়ে দেখল, তার চোখে এক ফোঁটা জল চিকচিক করছে, যা কুয়াশার সাথে মিলিয়ে এক রহস্যময় আলো তৈরি করেছে।
এরপর হঠাৎ কুয়াশা ঘন হতে লাগল। যুবতী ধীরে ধীরে কুয়াশায় মিশে যেতে লাগল, তার অবয়ব মিলিয়ে গেল। কেবল থেকে গেল বাঁশির সেই সুর আর শীতল বাতাসের হিম হাওয়া।
পথিক ধীরে ধীরে ফিরে চলল। তার মনে গভীর এক বিষণ্ণতা, সে জানত এই কুয়াশা ভেজা রাতের গল্প সে কখনো ভুলতে পারবে না। সেই সুরেলা বাঁশির সুর আর যুবতীর অপেক্ষার গল্প তাকে বারবার মনে করিয়ে দেবে, কিছু প্রতীক্ষা কখনো শেষ হয় না।